অর্পিত সম্পত্তি আইন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর

অর্পিত সম্পতি আইন সম্পর্কে যা জান লেখ।

ভূমিকা: ব্রিটিশ উপমহাদেশের কাছ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ সৃষ্টি হয়। আর ১৯৬৫ সালে এ বিরোধের জের ধরে দেশ দুটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ঐতিহাসিক তাসখন্দ চুক্তির মধ্য দিয়ে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধে যারা পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার শত্রুসম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে।

অর্পিত সম্পত্তি আইন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৭ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীন সরকার মহামান্য রাষ্ট্রপতির ৪নং অধ্যাদেশ দ্বারা শত্রুসম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তিকে হিসেবে চিহ্নিত করে।


অর্পিত সম্পত্তি আইনের সূচনা

১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলাকালীন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার “Defence of Pakistan Ordinance” নামে একটি প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ জারি করে। এর আওতায় “Pakistan Defence Rules” প্রণয়ন করা হয়, যার ১৮২(১)(খ) ধারায় “শত্রুসম্পত্তি” চিহ্নিত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ১৯৬৫ সালের ৩ ডিসেম্বর একটি আদেশ জারি করেন, যেখানে বলা হয়, যেসব ব্যক্তি পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে চলে গেছে, তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে থাকবে এবং এসব সম্পত্তি বিক্রি, হস্তান্তর বা ইজারা দেওয়া যাবে না।


এভাবেই পাকিস্তান আমলে “Enemy Property Act” বা “শত্রুসম্পত্তি আইন”-এর মাধ্যমে অসংখ্য হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। মূলত শত্রুসম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তি আইনের ইতিহাসকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-ে (ক) শত্রুসম্পত্তি আইনের অতীত ইতিহাস ও

(খ) শত্রুসম্পত্তি আইনের বাংলাদেশে বিবর্তন।


শত্রুসম্পত্তি আইনের অতীত ইতিহাস:

শত্রুসম্পত্তি আইনের ধারণা নতুন নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার ১৯১৬ সালে “Enemy Firms Act” এবং পরে ১৯২১ সালে “Enemy Missions Act” প্রণয়ন করে শত্রু রাষ্ট্রের সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও একই ধরনের আইন কার্যকর ছিল, তবে যুদ্ধ শেষে এসব আইন বাতিল করা হয়।

১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় ভারত ও পাকিস্তানও একই ধরণের আইন প্রণয়ন করে। পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর এই আইনকে স্থায়ী করে ফেলে, যা পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলে।

১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকার “East Pakistan Enemy Property (Administration and Disposal) Order, 1966” জারি করে। এতে তত্ত্বাবধায়ক, উপ-তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারী তত্ত্বাবধায়কদের নিয়োগ দেওয়া হয় এবং তাদেরকে এক বছরের মেয়াদে সম্পত্তি ইজারা দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের বহু জমি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চলে যায় এবং পরবর্তী সময়ে তা বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল আত্মসাৎ করে।


বাংলাদেশে অর্পিত সম্পত্তি আইনের বিবর্তন

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীন সরকার রাষ্ট্রপতির ৪নং অধ্যাদেশ জারি করে শত্রুসম্পত্তিকে “অর্পিত সম্পত্তি” (Vested Property) নামে পুনঃনামকরণ করে। অর্থাৎ, পাকিস্তান আমলের শত্রুসম্পত্তিই স্বাধীন বাংলাদেশে “অর্পিত সম্পত্তি” নামে পরিচিত হয়।

১৯৭৪ সালে সরকার “অর্পিত সম্পত্তি প্রশাসন আইন” প্রণয়ন করে, যার মাধ্যমে এসব সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার “অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন” প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়, যা ২০০১ সালে জাতীয় সংসদে পাস হয়।

এই আইনের মাধ্যমে প্রকৃত মালিকদের কাছে সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তবে আইন বাস্তবায়নে প্রশাসনিক জটিলতা, মামলা-মোকদ্দমা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এখনো বহু পরিবার তাদের সম্পত্তি ফিরে পায়নি।

 

সারাদেশে অর্পিত সম্পত্তি:

অর্পিত সম্পত্তির সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা কঠিন হলেও বিভিন্ন গবেষণা ও সরকারি পরিসংখ্যানে চিত্রটি ভয়াবহ।

১. অর্পিত সম্পত্তি হিসেরে তালিকাভুক্ত ৩ লাখ ৮৯ হাজার ১৯৭ একর জমি ও ১৩ হাজার ৪৩২টি বাড়ি সরকারের বেদখলে রয়েছে।

২. সারাদেশে ৭ লাখ ২২ হাজার ৩৩৫ একর জমি এবং ২২ হাজার ৮৩৫টি বাড়ি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছে।

৩. বেদখলি সম্পত্তি নিয়ে ১৮৭৯টি মামলা সুপ্রিম কোর্টে ও হাইকোট ও আপিল বিভাগের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মাবুল বরকত ও শফিক উপার্জনের গবেষণা জরিপে অর্পিত সম্পত্তির জমির পরিমাণ প্রায় ১৬ লাখ ৪০ হাজার একর যাব আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ৬০ হাজার কোটি টাকা।


৫. ভূমি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসেবে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন প্রণয়নের আগে এদেশে এ সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৪৩ হাজার ১৩৫ একর। আইনটি প্রণয়নের পর এ তালিকায় বর্তমানে জমির পরিমাণ ১ লাখ ৯৭ হাজার ২৫৭ একর।


উপসংহার: অর্পিত সম্পত্তি আইন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিতর্কিত অধ্যায়। মূলত ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ভারতে চলে যাওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য পাকিস্তান সরকার যে “শত্রুসম্পত্তি আইন” প্রণয়ন করেছিল, সেটিই স্বাধীন বাংলাদেশে “অর্পিত সম্পত্তি আইন” নামে বহাল থাকে।

যদিও পরবর্তীতে সরকার এই আইন সংস্কার ও প্রত্যর্পণের উদ্যোগ নিয়েছে, তবু এখনো হাজারো পরিবার তাদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি ফেরত পায়নি।

অতএব, প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সরকার ও নাগরিক সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে, যাতে বাংলাদেশের সংবিধানে ঘোষিত “সকল নাগরিকের সমঅধিকার” সত্যিকার অর্থেই বাস্তবায়িত হয়।

No comments:

Post a Comment